হাজরাপুর দরবার শরীফের দাদা পীর মরহুম ক্বারী আব্দুল হামিদ সাহেব (র:) একজন প্রখ্যাত ওলী এবং আধ্যাতিক জগতের এক উজ্জল নক্ষত্র ছিলেন।
মরহুম ক্বারী আব্দুল হামিদ সাহেব (র:) ১৮৭৮ সালে তৎকালীন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা বর্তমান মাদারীপুর জেলা মাদারীপুর সদর থানার অধিনস্ত পেয়ারপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। শিশু বয়সেই তিনি পিতৃহারা হলে পার্শ্ববর্তী রাস্তি ইউনিয়নের হাজরাপুর গ্রামে তাঁর মামা হাজী আব্দুল জব্বার সাহেবের নিকট লালিত পালিত হন।
শৈশবে উপনীত হলে তাঁর মামা "'হাজী আব্দুল জব্বার সাহেব"' তাঁর মেধাবী ভাগ্নে "'আব্দুল হামিদ সাহেব (র:)"' কে তৎকালীন বিখ্যাত ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় শিক্ষা অর্জনের জন্য প্রেরন করেন। তিনি সেখানে দ্বীনি ইলম অর্জনের পাশাপাশি এবং ইলমে তাজবীদে বুৎপত্তি অর্জন করে নিজেকে একজন যোগ্য ক্বারী হিসেবে অধিষ্ঠিত করেন।
ভারতের দেওবন্দে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি রশিদ আহমেদ গাঙ্গোহি (র:) এর নিকট তেলাওয়াত শুনান। ১৯০৫ সালে তিনি ভারতের ফুরফুরা দরবার শরীফ এর পীর মোজাদ্দেদে জামান হযরত পীর আবু বকর সিদ্দিকী (র:) এর নিকট বয়াত হন। এরপর তাঁরই নির্দেশক্রমে বাংলার জমীনের প্রখ্যাত ছারছীনার পীর নেছারুদ্দীন (র:) এর শরনাপন্ন হন এবং তাঁর থেকে খেলাফত প্রাপ্ত হন।
এরপর তিনি সুদূর নওগা জেলায় দ্বীনী খেদমত শুরু করেন। নওগা জেলার ঐতিহ্যবাহী মথুরাপুর এর জমীদার জনাব মো: মোজহার উদ্দীন তালুকদার ক্বারী আব্দুল হামিদ সাহেব (র.) এর আচরনে মুগ্ধ হয়ে ৪০০ বিঘা জমি উপঢৌকন দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর এ অসমান্য ত্যাগ, দুনিয়াবীমুখ পরহেজগারীতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বহন করে।
মরহুম ক্বারী আব্দুল হামিদ সাহেব (র.) এর দুই পুত্র ছিলেন। বড় পুত্রের নাম মেজর রঈস উদ্দীন আহেমেদ এবং দ্বিতীয় পুত্রের নাম আলহাজ্ব মোঃ আবু বকর সিদ্দীক। দাদা পীর সাহেব হুজুরের প্রথম পুত্র বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেন এবং ১৯৬০ দশকে পাকিস্তানের করাচীতে গিয়ে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। মেজর রঈস উদ্দীন আহমেদ পাকিস্তানের মিলিটারি কন্ট্রোলার হিসেবে সম্মানজনক পদে দায়িত্বরত ছিলেন এবং ২০০৪ সালে পাকিস্তানের করাচীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
হযরত দাদা পীর ক্বারী আব্দুল হামিদ সাহেব (র.) এর দ্বিতীয় পুত্র সম্তান আলহাজ্ব মোঃ আবু বকর সিদ্দীক, বর্তমানে হাজরাপুর দরবার শরীফের পীর হিসেবে দ্বীনের খেদমত করে যাচ্ছেন।
মাদারীপুর লোকালয়ে জনশ্রুতিতে নির্ভরশীল তথ্যে জানা যায় যেঃ ১৯৫২ সালে দাদা পীর ক্বারী আব্দুল হামিদ সাহেব (র.) এর দ্বিতীয় পুত্র মো: আবু বকর সিদ্দীক জন্ম গ্রহন করলে, তিনি নওগা জেলাতে বসেই আজান দেন। অসময়ে আজান দেওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে, প্রতিত্তুরে জানা যায় যেঃ এই মাত্র তাঁর একটি পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে, সুবহানাল্লাহ!
দাদা পীর সাহেব ক্বারী আব্দুল হামিদ সাহেব (র.) এর বিভিন্ন কারামত দিন দিন প্রকাশিত হতে থাকলে; তিনি নির্বিঘ্নে ইবাদত-বন্দেগী করার জন্য নওগা জেলা হতে প্রত্যাবর্তন করে; তাঁর মামা বাড়ী “হাজরাপুর” গ্রামে ফিরে এসে ইসলামের দাওয়াত প্রচারনার কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন এবং এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
তিনি একটি কাঁচারী ঘরের মসজিদ ভিত্তিক খানকা প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি গ্রামের ছোট-বড় সবাইকে "আপনি" সম্বোধন করে ডাকতেন। সালাতুল ইসতেসকা তথা বৃষ্টি প্রার্থনার নামাজ আদায় করে, তিনি বৃষ্টিসিক্ত জমীনে অঝর ধরায় বৃষ্টির পানিতে সকল মুসুল্লীদের নিয়ে ভিজেছেন। তাঁর দোয়ার বদৌলতে বর্তমানে হাজরাপুর গ্রাম সারা বাংলাদেশের মধ্যে একটি প্রাচুর্যতায় ভরপুর গ্রামে পরিণত হয়েছে। তাঁর ব্যবহারের মাধুর্যতা আজো মানুষ ভালোবাসার সহিত স্মরণ করে।
১৯৬৮ সালে বহু ভক্তবৃন্দকে রেখে, দাদা পীর শাহ সূফী হযরত মাওলানা ক্বারী আব্দুল হামিদ সাহেব (রহ.) ৯০ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন।
(إنا لله وإنا إليه راجعون)
কালক্রমে তাঁর যোগ্য পুত্র বর্তমান হাজরাপুর দরবার শরীফের বর্তমান পীর আলহাজ্ব আবু বকর সিদ্দীক সাহেব (জন্ম "'১৯৫২"') অল্প বয়সেই পিতৃহারা হলেও তিনি অদম্য সাহসীকতার সাথে ১৯৭৯ সাল থেকে এ দরবারকে, কাঁচারী ঘর হতে আধুনিক অট্টালিকায় রুপান্তরিত করেন।
তিনি দ্বীনি কাজের খেদমতের পাশাপাশি সামাজিক কাজেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
হাজরাপুর গ্রামে যেখানে রাস্তা ছিলনা, সেখানে তিনি রাস্তা নির্মান করেন। এরপর মাটির রাস্তা হতে পিচঢালা পাকা রাস্তা নির্মান হতে শুরু করে; হাজরাপুর ও চরমুগরীয়া বন্দরে যাওয়ার স্বপ্নের কাঙ্খিত ব্রীজ নির্মান করেন।
ব্রীজ ও রাস্তা নির্মানের বহু বছর পূর্বে, ১৯৮২ সালে হাজপুর দরবার শরীফ জামে মসজিদকে গোলপাতার কাঁচা ঘর হতে বিল্ডিং-এ রুপান্তরিত করেন, এছাড়া হাজরাপুর নেছারিয়া আলিয়া মাদরাসা, হাজরাপুর এতিমখানা, গেস্ট হাউজ সহ বিভিন্ন প্রকল্প সম্পন্ন করে হাজরাপুর গ্রামকে তিনি এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন।
দীর্ঘ ৪২ বছরের মাদারীপুরে সর্ববৃহৎ মাহফিলগুলোর মধ্যে অন্যতম মাহফিল হাজরাপুর দরবার শরীফে অনুষ্ঠিত হলেও, আশ্চর্যজনকভাবে সত্যি যেঃ মাহফিল চলা অবস্থায় দরবারের পক্ষ হতে জনসাধারণের নিকট হতে কোন প্রকার অর্থ উত্তোলন করা হয় না।
বর্তমান পীর বহু দু:খী মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছেন, বসবাসের জায়গা করে দিয়েছেন। মাহফিল পরিচালনা করার ক্ষেত্রে বর্তমান পীর সাহেব হুজুরের ভক্তবৃন্দ এবং গ্রামবাসীরা নিজেদের জান-মাল নিয়ে হুজুরের হাতকে শক্তিশালী করতে ঝাপিয়ে পরেন; তাদের একমাত্র উদ্দেশ্যই হলো লিল্লাহি্য়াত এবং মাহফিলকে সফল করা ও দূরের মেহমানদের খেদমত করা।
হাজরাপুর দরবার শরীফের উছিলায় মাদারীপুর জেলার বহু মাদ্রাসা-মসজিদে উন্নয়ন কাজ সংঘটিত হয়েছে।
বর্তমান পীর সাহেব হুজুর তাঁর বাবার আদর্শকে ধরে রাখার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গিয়েছেন। তিনি সৌদিআরবে, ইতালী, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ভারত, হংকং, চীন সহ পৃথিবীর প্রায় ৪০টি রাষ্ট্রে পরিভ্রমন করেন।
আলেম সমাজের নীতিগত চরিত্র, আখলাক ও আত্মিক উন্নয়নের জন্য মাদারীপুর জেলায় এক বৃহৎ ওলামা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে তিনি মাদারীপুর সম্মিলিত ওলামা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান উপদেষ্টা এবং মাদারীপুর আহমদিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মুহা. শাহাদাৎ হোসাইন এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে আছেন।
ফুরফুরা মাসলাকের মশাল হাতে নিয়ে এ দরবার দ্বীন প্রতিষ্ঠায় সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখতে ভূমিকা রাখছে। মাদারীপুরে অবস্থিত পখিরা ও খামারবাড়ী দরবার গুলোও হাজরাপুর দরবার শরীফের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে পাশে থেকে সহযোগীতা করে যাচ্ছে।
মাদারীপুরে ওলামায়ে কেরাম হতে সর্বস্তরের জনগন এ দরবারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ইতিমধ্যে হাজরাপুর দরবার শরীফের বর্তমান পীর আলহাজ্ব মোঃ আবু বকর সিদ্দীক হুজুরের সুযোগ্য সন্তান পীরজাদা আলহাজ্ব মাওলানা মুফতী মো: মহিউদ্দীন নূর তাজীম এ প্রতিষ্ঠানে দ্বীনী ও সামাজিক কাজে সহায়তা করে আসছেন।
তিনি ২০১৩ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া এর অধীনে ঢাকার ডেমরায় অবস্থিত দারুন্নাজাত সিদ্দীকিয়া কামিল মাদরাসা হতে কামিল হাদীস বিভাগে ফার্স্ট ক্লাস অর্জন করেন ও ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে অবস্থিত তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা হতে তাফসীরে ফার্স্ট ক্লাস (২০১৫) এবং ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কামিল ফিকহে ফার্স্ট ক্লাস (২০১৮) পেয়ে পাশ করেন।
দ্বিনী ইলম অর্জনের পাশাপাশি তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা কলেজ হতে ২০১৩ সালে (সমাজবিজ্ঞান) অনার্স পাশ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর অধীনে (সমাজবিজ্ঞান) মাস্টার্স পাশ করেন। এছাড়াও দারুন্নাজাত কামিল মাদরাসা হতে হাদীসের সনদ অর্জনের পাশাপাশি সিলেটের আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী (র:) এর প্রতিষ্ঠিত দারুল কিরাত মজীদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট হতে কুরআন তেলাওয়াতের সনদ অর্জন করেন।
বর্তমান পীর আলহাজ্ব মুহা. আবু বকর সিদ্দীক মনে করেনঃ “একজন পীর মানে নগন্য একজন খাদেম মাত্র! তাকে সর্বস্তরের জনগনের পাশে দাঁড়াতে হবে, মেহনত করতে হবে, অর্থ দিয়ে জনগনের কল্যানে নিজেকে সপে দিতে হবে, ত্যাগী মানুষ হতে হবে, সংগ্রামী-বিপ্লবী চেতনা থাকতে হবে; সর্বোপরি ধৈর্য এবং সৎ সাহস রেখে সর্বদা আল্লাহর উপর ভরসা রেখে সুন্নাহ ভিত্তিক জীবন গঠনে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে।”
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস